20200811

কাকাবাবু কি সত্যিই ৫আগস্ট জন্মেছিলেন?

অজয় দাশগুপ্ত

আজ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ১৩২তম জন্মদিবস। এবারে করোনা আবহে শারীরিক দুরত্ববিধি এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষা সংক্রান্ত সতর্কতা অবলম্বন করেই কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মদিবস উদযাপিত হবে। একথা আমরা সবাই জানি যে ১৮৮৯ সালের ৫আগস্ট অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালি জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) সন্দ্বীপে তিনি জন্মেছিলেন। 

কিন্তু কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ বা সর্বজনশ্রদ্ধেয় কাকাবাবুর জন্মদিবস সত্যিই ৫আগস্ট কিনা এবিষয়ে সংশয় রয়েছে! কেন একথা বলছি? তাহলে আসুন, দেখি কাকাবাবু নিজেই তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে কী বলেছেন! 

কাকাবাবু তাঁর জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিশদে লিখেছেন ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’ বইটিতে। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশিত এই বইটি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের পার্টিজীবনের গোড়াতেই অবশ্যপাঠ্য। এই বইতেই তিনি লিখছেন: ‘‘বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক সোমবারে আমি এই দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মেছি। আমাদের দরিদ্র পরিবারের কারুরই জন্মবার্ষিকী পালিত হত না। আমার জন্মতারিখও কোনদিন পালিত হয়নি। তাই জন্মের তারিখ আমার মনে নেই, মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস ও বারের কথাই আমার মনে আটকে রয়েছে। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭ই, ১৪ই, ২১শে ও ২৮শে তারিখ সোমবার ছিল। খ্রিস্টীয় সনের হিসাবে এই তারিখগুলি ১৮৮৯ সালের ২২শে জুলাই, ২৯শে জুলাই, ৫ই আগস্ট ও ১২ই আগস্ট। এই চারটি তারিখের মধ্যে কোনটি ছিল আমার প্রকৃত জন্মদিন তা জানার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত আগস্ট মাসকেই আমি আমার জন্মের মাস বলে থাকি।’’ 

ফলে তিনি আদৌ ৫আগস্ট জন্মেছিলেন কিনা এবিষয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু কাকাবাবুর জন্মদিবস পালনের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম জড়িত ছিল, সেই ঐতিহ্যকে কখনো অস্বীকার করা যায় না। কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনও জন্মদিবস বা মৃত্যুদিবস উদ্‌যাপন করা হয় না। মতাদর্শগত সংগ্রামের একটা বিশেষ প্রেক্ষিতেই কমরেড মুজ্‌ফফর আহ্‌মদের জন্মদিবস উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে যাঁরা সিপিআই(এম)-এ যুক্ত হয়েছিলেন, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সেই অংশের অধিকাংশই তখন হয় কারাগারে, নয় আত্মগোপন করে আন্ডারগ্রাউন্ডে। প্রকাশ্যে তখন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করার উপায় ছিল না। অথচ বিরাট অংশের পার্টিকর্মী ও সমর্থক-দরদীদের কাছে বামপন্থী বিপ্লবী অংশের পক্ষ থেকে বার্তা পৌঁছানো দরকার ছিল। সেকারণেই জন্মদিবস পালনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে বিমান বসু লিখেছেন: ‘‘সাধারণভাবে আমাদের পার্টির কোনো নেতার জন্মদিন বা মৃত্যুদিন প্রকাশ্যে পালন করার রীতি চালু নেই। কিন্তু কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রমী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬৩ সালে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এবং পার্টি সংগঠনের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে বিতর্ক দেখা দিলে প্রকাশ্য পার্টি, জেল পার্টি ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির যৌথ সিদ্ধান্তে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রথমবার তাঁর জন্মদিন পালিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে মুজফ্‌ফর সাহেব এই জন্মদিন পালনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মদিন পালনের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিপূজার বিষয়টি এসে যায়।’ তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ‘আপনার বিষয়টি একটু আলাদা, কারণ আপনি আমাদের পার্টির শীলমোহর হয়ে গেছেন।’ উত্তরে মুজফ্‌ফর সাহেব বলেছিলেন, ‘তা আবার হয় নাকি!’’ (সূত্র: গণশক্তি, ৫ আগস্ট, ২০১৬) 

১৯৬৩ সালের ৫আগস্ট কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রথমবার কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মদিবস বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মোহিত মৈত্রের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। কেন জন্মদিবস পালন, তার এই ইতিহাস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয় 


কমরেড মুজফফর আহমদকে সর্বমোট আট বছর আত্মগোপন করে কাজ করতে হয়েছিল। মুজফফর আহমদ পার্টি ও বাইরের লোকের কাছ “কাকাবাবু” হিসেবেই পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার-আচরণ ও ব্যবহারেও কাকাবাবুর মতই তাঁকে মনে হতো। বিশেষ করে সকলকেই তিনি স্নেহের চোখে দেখতেন। তিনি নারীদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখাতেন এবং অপরকে সেইমত ব্যবহার করতে শেখাতেন। কেন এবং কী করে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সবার ‘কাকাবাবু’ হয়ে উঠলেন, সেই ইতিহাসও খুবই আকর্ষণীয়। 

কাকাবাবু’ ডাকনাম প্রসঙ্গে কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘‘আত্মগোপন করার নিয়ম-কানুন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ করা সতর্কতা অবলম্বনের বিধি-নিষেধগুলি তিনি (কমরেড মুজফফর আহমদ) অন্যান্য কর্মীদের শিখিয়ে দিতেন। ১৯৪০ সালে গোপন আবাসে চলে যাবার পর আমিও তাঁর কাছ থেকে এসব নিয়ম-কানুন শিখেছিলাম। তখন নানা কায়দায় আমরা ফ্ল্যাট বা বাড়িভাড়া করতাম। একবার আমরা একটা বড়ো ফ্ল্যাটভাড়া নিই। মুজফফর আহমদকে আমিই “কাকাবাবু” নাম দিই। এভাবে সমস্ত পরিবারটিকে সাজানো হয়। দুই একজন মহিলা কর্মীকেও আনা হলো স্বাভাবিক পারিবারিক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য। বাড়ির মালিককে যা বলা হলো তা হচ্ছে এইরূপ, কাকাবাবু জমিদার, অনেক টাকাপয়সা নিয়ে এপার বাংলায় এসেছেন, ভাইপোদের নিয়ে থাকেন। ভাইপোরা সন্ধ্যেবেলায় ফুর্তি করতে বের হয় আর সারাদিন বাড়িতে ঘুমোয়। কারণ রাত্রেই আমাদের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় গিয়ে যোগাযোগ ও বৈঠক করা হতো। পাঁচুগোপাল ভাদুড়ীকে বড়দা ও সোমনাথ লাহিড়ীকে মেজদা করা হলো। আর আমি ছিলাম ছোড়দা.........।’’ (সূত্র: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা; প্রথম খন্ড) 

পরবর্তীকালে পার্টি প্রকাশ্যে এলেও কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সবার কাছে ‘কাকাবাবু’-ই থেকে যান। 

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই পথিকৃৎ অমর বিপ্লবীকে তাঁর জন্মদিবসে লাল সেলাম জানাই। 

ছবি: ১৯৬৩সালের ৫আগস্ট রামমোহন লাইব্রেরি হলে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের প্রথমবার জন্মদিবস উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন মোহিত মৈত্র। ছবিটি সোহম দাশগুপ্তের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত। 

৫আগস্ট, ২০২০