20110629

‘কাকাবাবু’ কমরেড মুজফফর আহমদ

দীপংকর গৌতম
Jul 20 14:37
Last Updated on Tue, 03 Aug 2010 17:44



এই বাংলায় জন্মেছিলেন এক বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী। সবাই তাঁকে ডাকতো কাকাবাবু নামে। তাঁর আসল নাম মুজফফর আহমদ। জীবন কর্ম যাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকালব্যাপী।



বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। মেঘনা মোহনার সাগর সঙ্গমে এর অবস্থান। এটি তিন হাজার বছরের আবাদ বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন সন্দ্বীপের অবস্থান ছিল দক্ষিণ ফরিদপুরের লাগোয়া মেঘনা বক্ষে। লাগাতার ভাঙা-গড়ার ফলে এ দ্বীপের ভৌগলিক অবস্থানের পরিবর্তণ এবং আয়তনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে চলেছে।



‘এ-কূল ভাঙ্গে ও-কূল গড়ে’ এর সাথে সন্দ্বীপের লোকাচার ও প্রশাসনের ক্ষেত্রেও কালে কালে ঘটেছে রদবদল। ব্রিটিশ আমলে ১৮৫৮ সালে নোয়াখালি জেলার সৃষ্টি এবং সন্দ্বীপকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপ থানা চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।



সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট মুজফফর আহমদের জন্ম। নিজের জন্ম তারিখ সম্পর্কে মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ‘বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক সোমবারে আমি এই দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মেছি। আমাদের দরিদ্র পরিবারের কারুরই জন্মবার্ষিকী পালিত হত না। আমার জন্ম তারিখও কোন দিন পালিত হয়নি। তাই জন্মের তারিখ আমার মনে নেই, মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস ও বারের কথাই আমার মনে আটকে রয়েছে। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭ই, ১৪ই, ২১শে ও ২৮শে তারিখ সোবার ছিল। খ্রিস্টীয় সনের হিসাবে এই তারিখগুলি ১৮৯ সালের ২২শে জুলাই, ২৯শে জুলাই, ৫ই আগস্ট ও ১২ই আগস্ট। এই চারটি তারিখের মধ্যে কোনটি ছিল আমার প্রকৃত জন্ম দিন তা জানার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত আগস্ট মাসকেই আমি আমার জন্মের মাস বলে থাকি।



পরে মুজফফর আহমদ ৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন বলে মনস্থির করেন। বাবা মুন্সি মনসুর আলি (১৮২৭-১৯০৫) ছিলেন সন্দ্বীপ আদালতের মোক্তার। মা চুনা বিবি। চুনা বিবি মুন্সী মনসুর আলির দ্বিতীয় স্ত্রী। মুজফফর তাঁর বড় ভাই মহব্বত আলি, মকবুল আলি ও খুরশিদ আলম। সবচেয়ে বড়জন ছিলেন উকিলের মোহরার। দ্বিতীয়জন স্কুল শিক্ষক ও তৃতীয়জন জমিদারি এস্টেটের কেরানি। মুজফফর আহমদের বাবার আয় খুব কম ছিল। বার্ধকেল কারণে তিনি আদালতে যাওয়া একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। তাঁর সম বয়সের লোকরা প্রায় প্রত্যেকেই ভালো ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু মনসুর আলি তা হয় নি। তাই মুজফফর আহমদের শিশু বয়সে পরিবারের দারিদ্র ছিল অবর্ণনীয়।



মুন্সি মনসুর আলি নিজে ফার্সি ভাষায় আইন পড়লেও মাতৃভাষা শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন। সাড়ে চার বছর বয়সের সময় তিনি মুজফফর আহমদকে বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা দেন।



মদন মোহন তর্কালঙ্কারের শিশু শিক্ষা প্রথম ভাগ দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি। ১৮৯৭ সালে তাঁকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। একজন শিক্ষক ছিলেন পূর্ণচন্দ্র নাথ (যোগী), তাঁর হস্তাক্ষর খুব সুন্দর ছিল। কলাপাতায় কালো কালিতে তিনি গোটা গোটা অক্ষর লিখে দিতেন। ছাত্ররা সেই লেখার ওপর কঞ্চির কলম বুলিয়ে লেখা শিখত। মুজফফর আহমদের সুন্দর হাতের লেখা এভাবেই শেখা হয়েছিল।



১৮৯৯ সালে মুজফফর আহমদকে হরিশপুর মডেল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দু’বছরের বেশি পড়ার খরচ চালানো সম্ভব হয়নি। স্কুলে বেতন বাকি পড়ায় তাঁর নাম কাটা যায়। এ সময়ে বাড়িতে অলস বসে না থেকে মুজফফর আহমদ একজন মাদ্রাসার ছাত্রের কাছে কোরান পাঠ শেখেন। এ ছাড়া ফার্সি ভাষায় লেখা মহাকবি শেখ সা’দির বই পড়েন। স্কুলের মত মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি ও ফার্সি পড়তে শুরু করেন। বামনির আখ্তারিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় ১৯০৫ সালে তাঁর বাবার মুত্যু হয়। এসময় ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর উমেশ চন্দ্র দাশ গুপ্ত মুজফফর আহমদকে ইংরেজি পড়ার জন্য উৎসাহ দেন। তিনি বরিশালের বুড়িরচর গ্রামে যান। সেখানে এক কৃষক পরিবারে শিশুদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। উদ্দেশ্য, কিছু টাকাকড়ি সঞ্চয় করে বরিশালের কোন স্কুলে ভর্তি হওয়া। ইতোমধ্যে বড় ভাই মকবুল আলি খোঁজ-খবর নিয়ে বুড়িরচরে গিয়ে মুজফফর আহমদকে সন্দ্বীপে ফিরিয়ে নিয়ে যান। প্রথবার স্কুল ছাড়ার পাঁচ বছর পর তাঁকে আবারও সন্দ্বীপের স্কুলে ভর্তি করা হয়। উল্লেখ্য, হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে ১৯০২ সাল থেকে কার্গিল হাইস্কুলে উন্নীত হয়েছিল।



মুজফফর আহমদের ভাষায়ঃ “১৯০৬ সালের মার্চ মাসে আমি সন্দ্বীপের কার্গিল হাইস্কুলে নীচের ক্লাশে ভর্তি হলাম। আমার তখন ষোল-সতের বছর বয়স। ক্লাসের ছোট ছোট ছেলেরা তা সত্বেও আমাকে ক্লাশে বসতে দিল, -----তার কারণ আমি তাদের তুলনায় বাংলা অনেক ভালো জানতাম। মাদ্রাসায় পড়ার সময়েও আমি বাংলা চর্চা কখনও ছেড়ে দেইনি। তার মানে বাংলা বই পেলে আমি পড়তাম, বাংলা মাসিক বা সাপ্তাহিক কাগজ পেলে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত না পড়া ছেড়ে দিতাম না। মাসিক কাগজে নানারকম প্রবন্ধ পড়া হতেই আমার মনে ইংরেজী শেখার আকাঙ্খা জেগেছিল। ------- ইংরেজি ভাষা শিখে তাতে একজন পন্ডিত হয়ে যাব এই উদ্দেশ্য আমার ছিল না। আমার একান্ত বাসনা ছিল ইংরেজী বই বুঝতে পারা।”



১৯১০ সালে মুজফফর আহমদ নোয়াখালি জেলা স্কুলে চলে যান। ১৯১৩ সালে সে স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। এরপর তিনি হুগলি কলেজে (বর্তমান মহসিন কলেজ) আই এ ক্লাশে ভর্তি হন। বরাবরই তিনি ছেলে পড়িয়ে নিজের খরচের টাকা যোগাড় করতেন। এ ছাড়া তার বড় ভাই কিছু টাকা দিতেন। হুগলিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি কলকাতা চলে যান এবং বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষা দিয়ে তিনি অকৃতকার্য হন।



ছাত্রজীবনে মুজফফর আহমদ অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলেন। জীবিকার জন্য ছেলে পড়াতেন বটে, কিন্তু বীজগণিত এড়িয়ে যেতেন। তিনি বাংলা কাব্য ও সাহিত্য পাঠে ছিলেন খুবই মনোযোগী। নিজেও কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতেন। ১৯০৭ সালে সর্বপ্রথম তাঁর একটা লেখা প্রকাশিত হয় কলকাতার সাপ্তাহিক ‘সুলতান’-এ। এ সময় তিনি সন্দ্বীপ থেকে স্থানীয় খবর পাঠাতেন ঐ পত্রিকায়। সম্পাদক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাঁকে লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হয়। ‘সুলতান’- এ প্রকাশিত এ বিষয়ক বিপক্ষে তিনি কোন আকষণ বোধ করেননি। তাঁর ভাষায়, “আমি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোন আন্দোলনেই যোগ দেইনি। তখন আমার যে বয়স ছিল তাতে কোন এক পক্ষে যোগ দিলে আমার পক্ষে তা মোটেই বেমানান হতো না। আমার বয়সের অনেক ছেলে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।”


আই এ ক্লাশে পড়ার সময়ই মুজফফর আহমদ কলকাতায় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভ্য হন। ১৯১৫ সালে সমিতির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদিকে জীবিকার জন্যে কিছু করা দরকার হয়ে পড়ে। এক বছর ধরে এখানে ওখানে চাকরি করেন। ১৯১৭ সালে যোগ দেন বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেসের সহকারী স্টোর কিপার পদে। এ কাজে তিনি এক বছর বহাল থাকেন। মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। এরপর মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদকের কাজ করেন। এই চাকরির স্থিতিকাল ছিল মাত্র একমাস। পরের একমাস তিনি কলকাতায় স্কুল পরিদর্শকের অফিসে কাজ করেন। ১৯১৮ সালে মুজফফর আহমদ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সার্বক্ষণিক কর্মী হন। তিনি উদ্যোগী হয়ে ৩২ নয় কলেজ স্ট্রিটে ষাট টাকা ভাড়ায় সমিতির কার্যালয় স্থাপন করেন। এই সময়ে ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশ করা হয়। পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের নাম ছাপা হলেও সম্পাদকীয়র সব কাজ মুজফফর আহমদই করতেন। কাজী নজরুল ইসলাম তখন বাঙালি রেজিমন্টে ছিলেন। তাঁর লেখা অনেক কবিতা এই পত্রিবায় প্রকাশিত হয়। পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মুজফফর আহমদ-এর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।


১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম মহাযুদ্ধের বিরতি ঘটে। ১৯২০ সালে গোড়ার দিকে ৪৯ নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। তখন ঐ রেজিমেন্টের হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় চলে আসেন এবং সমিতিরি বাড়িতে ওঠেন। মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন একসাথে থাকেন। অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মুজফফর আহমদ-এর পরামর্শে তিনি সে চাকরির ব্যাপারের উৎসাহী হননি।


ঐ সময়ে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন কংগ্রেসে ও খেলাফতের একজন বড় নেতা। মুজফফর আহমদ তাঁর কাছে একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব দিয়ে ফজলুল হক সম্মতি দেন। ১৯২০ সালে দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফফর আহমদের সম্পাদনায়। সরকার বিরোধী লেখা প্রকাশের জন ‘নবযুগ’- এর এক হাজার টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। মুজফফর আহমদ আবার ফজলুল হকের কাছ থেকে দু’হাজার টাকা নিয়ে জামানত পেশ করেন। ‘নবযুগ’ চারহাজার কপি ছাপা হত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’র জাগরণমূলক কবিতাগুলো এ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।


নিজের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে মুজফফর আহমদ সাহিত্য ও রাজনীতিকে এক সূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, “আমার জীবনের পেশা কি হবে- সাহিত্য না রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল। কবি আমি ছিলাম না। গল্প লেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনদিন আমার আয়ত্তে ছিল না। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে, আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও অর্থাৎ রাজনীতিক জীবনে তা হওয়ার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবুও আমি প্রবন্ধকারও হতে পারি-না। যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি। ----- আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির। একটা কিছুতে নিজেকে যে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলাম। সেই জন্য তো আমি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সব সময়ের কর্মী হতে পেরেছিলাম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে, রাজনীতেই হবে আমার পেশা। আমি রাজনৈতিক সভা সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলাম তো ১৯১৬ সাল থেকেই।



যুদ্ধের শেষে সারা পৃথিবীতে একটা নব জাগরণের সাড়া পড়ে যার, ভারতবর্ষে খেলাফত ও কংগ্রেসের আন্দোলন শুরু হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলকাতা টাউন হলে পরপর তিন দনি ছয় ঘন্টা করে বক্তৃতা করেন। মুজফফর আহমদ সেই বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে বিপ্লব হয়, তাও তাকে প্রভাবিত করে। রুশ বিপ্লবের কিছু কিছু তথ্য প্রচার পুস্তিকা ও মার্কসবাদী সাহিত্য গোপন পথে এদেশে আসতে শুরু করে। মুজফফর আহমদ তা পাঠ করে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।


এদিকে আমদের জনগণের দুঃখ-দুর্দশার একজন ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মুজফফর আহমদ। সন্দ্বীপের বেশির ভাগ লোক ছিলেন জাহাজের নাবিক। তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের কথা মুজফফর আহমদ জানতেন।



‘নবযুগ’ কৃষক-মজুরের দাবির সমর্থনে মতামত রাখত। এ ব্যাপারে ফজলুল হকের কাছে কেউ বিরূপ মন্তব্য রাখত। এ সম্পাদকীয় নীতিমালা বেঁধে দিতে উদ্যত হন। এ অবস্থায় প্রথমে কাজী নজরুল ইসলাম ও পরে মুজফফর আহমদ ‘নবযুগ’-এর কাজ ছেড়ে দেন। পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়।



এবারে মুজফফর আহমদ আর একটি কাগজ বের করার লক্ষ্যে একটি কোম্পানি গড়তে উদ্যোগী হন। কিন্তু কোম্পানি রেজিস্ট্রি করারও পয়সা নেই। এগিয়ে এলেন নতুন পরিচিত কুতুবুদ্দিন আহম্মদ। তিনিই টাকা দিলেন, এই মর্মে একটি ঘোষণাপত্র লেখা হল। কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রকাশিত কাগজটি হবে মজুর-কৃষকদের মুখপত্র। মুজফফর আহমদের বাংলা খসড়াটির ইংরেজি অনুবাদে মজুর-এর ইংরেজি করা হয়- প্রোলেটারিয়েট। অক্সফোর্ড ডিকশনারি দেখে মুজফফর আহমদকে শব্দটি বুঝতে হয়েছিল। সেটাই সম্ভবত আমাদের দেশে প্রেলেটারিয়েট শব্দটির প্রথম প্রয়োগ। এ দিকে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি না হওয়ায় কাগজ বের করা সম্ভব হয়নি। নিজস্ব কাগজ বের করা না গেলেও মুজফফর আহমদ বিভিন্ন সাময়িকীতে লিখতে থাকেন। একই সঙ্গে রুশ বিপ্লব ও মার্কসবাদের বইগুলো খুঁজে খুঁকে পড়তে থাকেন। জানা যায়, সন্দ্বীপের জাহাজিরা মুজফফর আহমদকে এসব বই এনে দিতেন। ইংরেজিতে লেখা বই পড়ে বুঝতে তাঁর কষ্ট হত। তবু তিনি ভেবে নিতেন, এটাই তাঁর পথ। এদিকে মস্কোতে ‘কমিউটিস্ট ইন্টারনাশনাল’ নামে একটি প্রচার সংগঠন গঠিত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।


১৯২১ সালের শেষ ভাগে ঐ সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। একই সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন। তাঁদের সাথেও মুজফফর আহমদের যোগাযোগ হয়, তাঁরা হলেন মুম্বাই-এর শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, মস্কো থেকে কাবুলে আগত মোহাম্মদ আলি, পেশোয়ার ইসলামকি কলেজের অধ্যাপক গোলাম হোসেন প্রমুখ। এছাড়া ১৯২২ সালের শেষ দিকে মস্কো থেকে কলকাতায় প্রত্যাগত শওকত ওসমানির সাথেও মুজফফর আহমদের পরিচয় হয়। এভাবে ভারতবর্ষে যাঁরা কমিউনিজম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন তাঁদের মধ্যে ১৯২১ সালে যোগাযোগ স্থাপিত হয়।



১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় বৈঠকের পর থেকে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চলতে থাকে। সে বছর ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। উদ্যোক্তা ছিলেন এম. এন. রায়। ১৯২১ সালে এ পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনাল এর অনুমোদন পায়। এই প্রবাসী পার্টির কাজ জার্মানিতেও সম্প্রসারিত হয়। জার্মানি থেকে ১৯২২ সালে ১৫ মে পার্টির পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকা ডাকযোগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পাঠানো হত। এক সময় এ পত্রিকা পুলিশের হাতে পড়ে। মুজফফর আহমদ তখন পত্রিকার নাম পরিবর্তনের জন্যে এম. এন. রায়কে লেখেন। এম. এন. রায় পত্রিকাটির নতুন নামকরণ করেন। ভারতবর্ষের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ বলেন, ‘আগে পরে চার জায়গায় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। উদ্যোক্তারা একত্রে মিলিত হয়ে আলোচনা করে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা নয়, প্রত্যেক জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় ছিল না। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। প্রথম চারটি জায়গা হলো কলকাতা, বোম্বে (মুম্বাই), লাহোর ও মাদ্রাজ। এক জায়গা হতে অন্য জায়গার দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও অনেক বেশি। এত দূরে থেকেও আমরা সারা ভারতের পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলাম। কারণ কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। আমাদের সকলের মধ্যে বিন্দু ছিল কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনাল। তার কেন্দ্র ছিল বহু হাজার মাইল দূরে মস্কোতে। এই চারটি জায়গায় প্রত্রোকটির সঙ্গে কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনাল-এর স্বাধীন ভাবে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালই কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের একজনের সঙ্গে অপরের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।



দেশের ভেতর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রধান উদ্যোক্তারা হলেন কলকাতায় মুজফফর আহমদ, মুম্বেতে শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, লাহোরে গোলাম হোসেন, মাদ্রাজে মলয়পুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার প্রমুখ।


মুজফফর আহমদের একটি ক্ষোভ ছিল - তাঁর ভাষায়: ‘অন্যান্য দেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন বিরাট বিরাট বুদ্ধিজীবী, রাশিয়াতে প্লেখানভ, চীনে চেনতুসিউ। তাঁরা নিজেরা পরে সরে গেলেও পার্টিকে দিয়ে গিয়েছিলেন বিরাট বিরাট মানুষ, প্লেখানভ দিয়ে গিয়েছিলেন লেনিনকে, চেনতুসিউ মাও সেতুংকে। আপনাদের দুর্ভগ্য, ভারতের পার্র্টি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল আমাকে, আর ডাঙ্গেকে। আমরা কেউই বিরাট বুদ্ধিজীবী নই। তার ফলে পার্টি তত্ত্বগত ক্ষেত্রে অনেক কিছু কাঁচা রয়ে গেছে। আপনাদের সচেষ্ট হতে হবে যাতে নিজেদের উপযুক্তভাবে তৈরী করে পার্টির এই দুর্বলতা দূর করতে পারেন।’


১৯২৩ সাল থেকে মুজফফর আহমদ বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন। আগেই জড়িত হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সীমেন্ত এসোসিয়েশনের সঙ্গে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করেন। ওই বছরের ১৭ মে তাঁকে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার করে রাজবন্দি হিসেবে কারাগার আটক রাখার হয়। ঐ সময়ে পেশোয়ারে ভারতবর্ষে র প্রথম কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মালমলা চলছিল। চেষ্টা করা হয়েছিল ঐ মামলায় মুজফফর আহমদকে জড়ানোর। কিন্তু প্রমাণাভাবে তা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার মুজফফর আহমদ, শ্রীপদ আমৃত ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি ও নলিনী গুপ্তের চার বছরের সাজা হয়। জেলখানায় মুজফফর আহমদের ক্ষয় রোগ হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে আলিপু, ঢাকা, কলকাতা প্রেসিডেন্সি, কানপুর, রায়বেরিলী ও আলজোড়া ইত্যাদি জেল বদলিয়ে ১৯২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয়। কারামুক্তির পর তাঁর স্বাস্থের উন্নতি হতে থাকে।



১৯২৬ সালে মুজফফর আহমদের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত হয় এক কৃষক সম্মেলন। সেখানেই ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ গঠিত হয়। ১৯২৭ সালে কলকাতায় ডক-মজুর ধর্মঘট ইত্যাদিতে মুজফফর মেথর ধর্মঘট, চটকল মজুর ধর্মঘট ইত্যাদিতে মুজফফর আহমদ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হয়। এসব আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি ও ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ একযোগে কাজ করে।



১৯২৯ সালের ২০ মার্চ সরকার বিভিন্ন এলাকা থেকে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে। মুজফফর আহমদও প্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়- ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা।’ এই মামলায় অভিযুক্ত হন মুজফফর আহমদ সহ মোট ৩১ জন। ৪ বছর ধরে চলে এ মামলা। ১৯৩৩ সালে ৯ জানুয়ারি মামলার রায় বের হয়। মুজফফর আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে আপিলে এ সাজা কমে গিয়ে ৩ বছর হয়। এই তিন বছর মুজফফর আহমদকে মীরাট, নৈনি, আলজোড়া, দার্জিলিং, বর্ধমান এবং ফরিদপুর জেলে রাখা হয়।



মীরাট মামলা ছিল পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘসূত্রী ও বড় ধরনের রাস্ট্রীয় বিচার। এ মামলায় ব্যয় হয়েছিল সেই সময়কার ৪০/৫০ লক্ষ টাকা। মুজফফর আহমদের ভাষায় ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হতে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট মতার্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের জেলে ও ক্যাম্পে দন্ডিত ও বিনা বিচারে আটক সন্ত্রাসবাদী বন্দীরা মার্কসীয় সাহিত্যের অধ্যয়ন শুরু করে দেন। আন্দামান জেলেও দন্ডিত বন্দীরা তা-ই করেন। এই ব্যাপারে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটিরও অবদান ছিল। মুক্তির মুক্তি পাওয়ার পর এ সব বন্দীর মধ্যে শত শত লোক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।’


একই প্রসঙ্গে অন্যত্র লেখা মুজফফর আহমদের ভাষ্যঃ ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় বন্দীরাই জিতেছিলেন। ------- বছরের পর বছর মামলা চালিয়ে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সারা বিশ্বে বন্দীদের প্রতি ঘৃণা উদ্রেকের পরিবর্তে সহানুভূতির উদ্রেক করেছিলেন। জগতের নানা স্থান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ এসেছিল মীরাট মামলা তুলে নেয়ার জন্য।’



জেল থেকে মুক্ত হবার পর পরই মুজফফর আহমদকে নজরবন্দি করা হয়। প্রথমে ফরিদপুর, পরে নিজের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে ও মেদিনীপুরের এক গ্রামে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়। সন্ত্রাসবাদীদের দমনের জন্য যে আইন চালু করা হয়েছিল, সে আইনে মুজফফর আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অথচ তিনি ছিলেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামী। এ অবস্থায় লন্ডনে মুজফফর আহমদের বন্ধুরা এ অন্যায়ের প্রতিকবার চেয়ে ভারত সচিবের কাছে ডেপুটেশন পাঠান। তারই ভিত্তিতে ১৯৩৬ সালের ২৫ জুন মুজফফর আহমদকে মুক্তি দেওয়া হয়।



দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে সরকার আবারও কমিউনিস্টদের প্রতি সন্দেহ পোষণ কতে থাকে। কলকাতায় শ্রমিকদের উপর মুজফফর আহমদের প্রভাব তখন খুব বেশি। এ অবস্থায় তাঁকে কলকাতা ছেড়ে যাবার আদেশ দেওয়া হয় ফেব্র“য়ারি মাসে। আদেশ অমান্য করায় এক মাসের জেল হয়। মুজ্ত হবার পর আবারও কলকাতা ছাড়ার আদেশ দেওয়া হয়। এবার তিনি প্রকাশ্যে কলকাতা ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু ২৩ জুন (১৯৪০) গোপনে কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন থেকে ১৯৪২ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত গোপনে পার্টির কাজ চালিয়ে যান।



পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে মুজফফর আহমদ নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। যে সব বিপ্লবী কর্মী কারামুক্ত হয়ে আসেন, তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জেলায় পার্টি গঠনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে যুক্তবঙ্গের ২৮টি জেলাতেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে।



এতটুকু সময়ের মধ্যে পার্টির সভ্য সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজারে উন্নীত হয়।


১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহের নেত্রোকোণাং নিখিতল ভারত কৃষক সম্মেলন হয়। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে মুজফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। উল্লেখ্য, কমিউনিস্ট চিন্তাধারা প্রচারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মুজফফর আহমদ ভারতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও কাজ করেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন কংগ্রেসের সভাপতি তখন কমিউনিস্টরাই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব তোলেন। এর পর ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ (বর্তমান নাম চেন্নাই) অধিবেশনে জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করেন। মুজফফর আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা প্রস্তাবটি সমর্থন করেন।



১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানে মুজফফর আহমদকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একক সম্মেলন হয় কলকাতায়, ঐ সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানি কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা আলাদা ভাবে কাজ চালানো সিদ্ধান্ত নেয়।



১৯৪৮ সালে ভারত সরকার নির্যাতনমূলক আইনে মুজফফর আহমদকে গ্রেপ্তার করে। ঐ সময় জেলখানায় রাজবন্দির মর্যাদা বাড়ানোর দাবি তোলা হয়। এ ব্যাপারে। সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি হয়। চুক্তিতে ভারত সরকারের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ও রাজবন্দিদের পক্ষে মুজফফর আহমত স্বাক্ষর করেন। ১৯৫১ সালের ২৭ এপ্রিল মুজফফর আহমদ মুক্তি পান। ১৮ মে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনিস্টিটিউট-এ তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।



এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতভেদ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও মতভেদের সৃষ্টি করে। ১৯৬৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুজফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশের নাম দেওয়া হয় সিপিআই (এম) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। মার্কসবাদী কমিউনিস্টরা অন্ধভাবে মস্কোকে অনুসরণ না করার নীতি গ্রহণ করেন।



১৯৬৯ সালে সশস্ত্র কৃষক অভূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে গঠিত হয় সিপিই (এম-এল) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এরা প্রধানত মাও সে তুং (মাও জে ডং) ও চীনের লাইনের অনুসারী। মুজফফর আহমদ এই সময়েও মস্কো ও পিকিং-এর অন্ধ অনুসরণের বিরোধিতা করেন।



আদর্শগত কারণে পার্টি থেকে যাদের বের করে দেওয়া হত, তারা যেন ভুল শুধরে আবার ফিরে আসেন, এ ব্য্পাারে মুজফফর আহমদ খুবই আগ্রহী ছিলেন। তার ভাষায়ঃ “কমরেডরা ভুলে যান যে একজনকে বহিষ্কার করতে লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু পার্টিতে আনতে লাগে কয়েক বছর। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যারা ভুল পথে গেছেন তারা যাতে আবার সঠিক পথে আসেন।’



১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সিপিআই (এম) পূর্ণ সমর্থন দেয়। ঐ দিনগুলোতে পার্টি মুখপত্র ‘গণশক্তি’র দৈনন্দিন সংবাদ সমালোচনা ও সম্পাদকীয় মতামতে তার স্বাক্ষর মেলে। মুজাফফর আহমদের ভাষায়ঃ “পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার হতে মুক্ত হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা যেভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন, তার তুলনা দুনিয়ার ইতিহাসে কম। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি একজন অক্ষম অসমর্থ বৃদ্ধ, যদি আমার শরীরে শক্তি থাকত, তা হলে আমিও বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজে যোগ দিতাম।


মুজফফর আহমদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে পার্টি অফিসে, কারাগারে কিংবা গোপন আস্তানায়। এ ছাড়া পার্টি কর্তৃক ভাড়া করা ঘরে অথবা কর্মস্থলে। নিজের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কিছু তিনি করেন নি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে পার্টি কর্র্র্তৃক নিয়োজিত একজন কর্মী তাঁর দেখাশুনা করতেন। মৃত্যুর আগে প্রায় সাত মাস তিনি কলকাতায় একিট নার্সিং হোমে কাটান। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।



ছেলেবেলা থেকেই মুজফফর আহমদের সাহিত্য চর্চার ঝোঁক ছিল। ছাত্র জীবনে অঙ্গে কাঁচা কিন্তু বাংলায় খুব ভালো ছিলেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দে তাঁর দু’টি কবিতা প্রকাশিত হয়। একটি কোহিনূর পত্রিকায়, শিরোনাম ‘প্রেমিকের পণ।’ অন্যটির শিরোনাম ‘বীর’ প্রকাশিত হয় ‘আল-এসলাম’ পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশিত গদ্য রচনা ‘সন্দ্বীপের পুন্যাল বৃক্ষ ও পুন্যাল তৈল’। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়।


রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুজফফর আহমদের অবদান অনেক। বিক্ষিপ্তভাবে বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। কিন্তু সেগুলোর সুষ্ঠু সংরক্ষণ হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাত্রাটি ছিল ব্যতিক্রমী। মুজফফর আহমদের ভাষায়ঃ ‘আমার নবযুগ এর জন্য লেখাগুলির অস্তিত্ব কোথাও নেই, খুব কম তো আমিও লিখিনি। সংরক্ষণের অভ্যাস না থাকাতে আমার অনেক লেখাই লোপ পেয়ে গিয়েছে।’


বাংলা ভাষায় শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের কথা ছিল মুজফফ আহমদের লেখার প্রধান বিষয়। একই সাথে তিনি কমিউনিজম সমর্থক পত্র পত্রিকায় প্রকাশেরও প্রত্যক্ষ উদ্যোগক্তা। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এই পত্রিকা মুজফফর আহমদ শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন সম্পর্কে নিয়মিত লিখতেন ‘দ্বৈপায়ণ’ ছদ্মনামে। ১৯২৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে কাজী নজরুল ইসলামের ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়। পরে মুজফফর আহমদও ‘লাঙল’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট থেকে ‘লাঙল’ পত্রিকা ‘গণবাণী’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে। ‘গণবাণী’র ডিক্লিয়ারেশনও নেওয়া হয় মুজফফর আহমদের নামে। ‘গণবাণী’ ১৯২৮ সাল পর্যন্ত চালু থাকে। এই পত্রিকাতেই সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট ইসতেহারের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।



মুজফফর আহমদের লক্ষ্য ছিল মার্কসবাদী সাহিত্য প্রচার ও পার্টির পত্রিকা প্রকাশ। এর জন্যে তিনি লেখন তৈরি, সাময়িকী প্রকাশ, ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থা গঠন ইত্যাদিতে নিয়োজিত ছিলেন। ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ ও গণশক্তি প্রেস’ তাঁর হাতে গড়া। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’ ও পরে দৈনিক ‘গণশক্তি’ প্রকাশের প্রধান উদ্রোক্তা ছিলেন মুজফফর আহমদ। পত্রিকা প্রকাশনার কাজে জামানত দাবি, নিষেধাজ্ঞা, নিজের কারাদন্ড এসব পোহাতে হলেও তিনি দমে যাননি। মুজফফর আহমদের ভাষায়ঃ ‘ছাপাখানা, কাগজ আর বই-এর ােদাকান এ তিনটি জিনিস ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। এরা আমার বেঁধে ফেলেছে।



মার্কসবাদী সাহিত্য তিনি নিজে পড়তেন এবং অন্যদের পড়াতেন। মুজফফর আহমদের উৎ সাহে মার্কসবাদীদের সংস্কৃতি দল ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ (আই, পি, টি, এ), ‘ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ এবং ‘প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী-সংস্থা’ গঠিত হয়।
মুজফফর আহমদের লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘কাজী নজরুল প্রসঙ্গেঃ স্মৃতিকথা’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ এবং ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা বইগুলো দেশ-কাল-পাত্রের চিত্র ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণমূলক। ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়।



‘আমার স্মৃতিকথা’ ‘সাংবাদিকতার এক অধ্যায়’ ইত্যাদি ৯টি রচনার একটি সংকলন ‘সময়কালের কথা’ গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালের দৈনিক ‘স্বাধীনতা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ (১৯২১-১৯৩)’ প্রবন্ধটি। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধের ইংরেজির অনুবাদ প্রথমে প্রকাশিত হয় দিল্লির মাসিক ‘নিউজ এইজ’ পত্রিকায়।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার প্রতম দলিল হিসেবে। ১৯৩৭ সালে মুজফফর আহমদ একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেটি ‘কৃষক সমস্যা’ শিরোনামে আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ও পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি ‘কৃষকের কথা’ শিরোনামেও পত্রান্তরে প্রকামিত হয়।




১৯৭৬ সালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি মুজফফর আহমদের ‘নির্বাচিত রচনা সংকলন’ প্রকাশ করে। ‘বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিকদল’, ‘কৃষক আন্দোলন’ ও ‘নলচিরা প্রজা সমিতির ৮ম বার্ষিক সম্মেলনে (১৩৩৯ বঙ্গাব্দে) প্রদত্ত ভাষণ’ ইত্যাদি পুস্তি কাকারে প্রকাশিত হয়।


বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত মুজফফর আহমদের কতিপয় প্রবন্ধের শিরোনামঃ ইমাম আল-গাজ্জালী (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৫), উর্দু ভাষা ও বঙ্গীয় মুসলমান (আল-এসলামম ১৯১৭), বঙ্গদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৩২৬) আরবি ভাষা (ঐ, ১৩২৬), দুর্যোগে পাড়ি। (মোসলেম ভারত ১ম বর্ষ ১ম খন্ড, বৈশাখ- আশ্বিন ১৩২৭), দ্বৈপায়ণের পত্র (ধূমকেতু, ১৯২২), গান্ধী চরিত (ঐ), ভারত কেন স্বাধীন নায় (লাঙল, ১৯২৬), কোথায় প্রতিকার (ঐ), শ্রেণী সংগ্রাম (ঐ), কৃষক ও শ্রমিকের আন্দোলন (ঐ), কারাগার সম্পর্কে সরকারের ওদাসীন্য (ঐ), এ ছাড়া ‘গণবাণীতে প্রকাশিত কতিপয় প্রবন্ধে শিরোনাম হচ্ছে: (১৯২৬ সালে) স্বরাজের স্বরূপ, শ্রমিক অসন্তোষ, নির্বাচন, ভবিষ্যৎ ভারত. কোন পথে, সাম্প্রদালিকতার বিষম পরিণাম, জনগণের কাজই রাজদ্রোহ ও নতুন দল, (১৯২৭ সালে) জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, অর্থনৈতিক অসন্তোষ, কৃষক সংগঠন, আসল কথাটা কি. মুক্তি সংগ্রাম, একখানা পত্র, ইস্পার কি উস্পার, ভদ্রশ্রেণী মানবিকতা, কি করা চই, খোলা চিঠির জওয়াব, নিবেদন, কৃষক ও শ্রমিক, এবং শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়, কৃষক ও শ্রমিক দল, সাইমন কমিশন, গণ-আন্দোলন ও কংগ্রেস, পরিপূর্ণ স্বাদীনতা, শ্রেণী বিরোধ ও কংগ্রেস ইত্যাদি এবং (১৯২৮ সালে) আত্মশক্তি ও আমরা এবং গোড়ায় গলদ। ১৯৩৭ সালে লেখা মুজফফর আহমদের দু’টি প্রবন্ধ- সোভিয়েত দেশের গৃহযুদ্ধের বিশ্বের শ্রমজীবী জনতা’ এবং কংগ্রেস আন্দোলনে নরম ও গরম দল’। ১৯৪৫ সালে সন্দ্বীপে দাঙ্গাবাজদের হাতের নিহত লাল মোহন সেনেরে উপর ‘পাছে না ভুলে যাই’ শীর্ষক এক অন্তরঙ্গ নিবন্ধ লিখেন মুজফফর আহমদ। ১৯৭৩ সালে লেখা তাঁর একটি প্রবন্ধের শিরোনাম সন্দ্বীপ ইংরেজি শিক্ষা।



স্মৃতিকথামূলক আরো কয়েকটি রচনা হচ্ছে ‘স্মৃতিকথা (নজরুল সম্পর্কে) ‘বিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত’ এবং ‘আলের সন্ধানে’ ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একখানা পুরানো দলিল’, ‘দু’খানা চিঠির ইতিহাস’, মীরাট মামলার যৎকিঞ্চিত’ ইত্যাদি।



১৩২৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় মুজফফর আহমদের ‘১বুইয়র-এর যুদ্ধ’ ‘ইনায়েত খান’ শীর্ষক দু’টি রচনা সংকলিত হয়। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামকে লিখিত পত্র-নিবন্ধ (২৬.০৬.১৯২১) ও ১৯২৬ সালে ‘গণবাণীতে প্রকাশিত ‘শিক্ষিত তরুণ মুসলিমগণের বরাবরে খোলাচিঠি’র সন্ধান পাওয়া যায়। রেবতীমোহন রমণের ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থে মুজফফর আহমদ কৃত লেখক পরিচিতি মুদ্রিত হয়। মুজফর আহমদ তিনটি গ্রন্থের ভূমিকা লিখেন। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, শান্তিপদ সিংহের ‘নজরুল কথা’, ‘সোমেন চন্দ্রের রচনা সংগ্রহ’ ও প্রমথ গুপ্তের ‘ট্রাইবাল পিপল ইন লিবারেশন স্ট্রাগল’।



বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় মুজফফর আহমদ গ্রন্থ সমালোচনাও করেন। লক্ষণীয়, তিনি তত্ত্বকথার চেয়ে স্মৃতি চারণমূলক লেখাই বেশি। লিছেখেন। এ প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদের প্রথম জীবনীকার রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের একটি উক্তি: ‘মুজফফর আহমদের জীবন সংক্ষেপে লিখলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসেও সংক্ষেপে লেখা হয়। পার্টির তাঁর জীবন-------।’
স্মৃতিচারণ নির্ভুল করার ব্যাপারে মুজফফর আহমদ ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। তাঁর মধ্যে ছিল গবেষকের উৎসাহ। ভবানী মুখাপাধ্যায়ের ভাষায়: ‘তিনি (মুজফফর আহমদ) বলতেন: আমি বরাবর অপরের ত্র“টি সংশোধনের জন্য কথা বলেছি, আমি নিজে যাদ ভুলভ্রান্তি করে বমি, লোকে কি বলবে! এই ছিল তাঁর কথা বলার ধরণ, অতি ক্ষীণকন্ঠে কি জোরালো যুক্তিই যে উচ্চারিত হতো-------।



বদরুদ্দিন উমরের ভাষায়: ‘তিনি (মুজফফর আহমদ) এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক প্রবন্ধ সাহিত্য বাংলা ভাষায় প্রচলিত ও জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁর পূর্বে প্রবন্ধ অনেকে লিখেছেন কিন্তু রাজনীতি বিষয়ক এবং বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষক নিপীড়িত মধ্যবিত্তের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সমস্যা এবং তাঁদের শোষণ মুক্তির আন্দোলন নিয়ে এত পরিচ্ছন্ন, দৃঢ়তাব্যঞ্জক এবং দিক নির্দেশক প্রবন্ধ তাঁর পূর্বে আর কেউই রচনা করতে সক্ষম হননি। এ ব্যাপারে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি নিঃসন্দেহে এক সম্ব পথিকৃত।


শিবরাম চক্রবর্তীর লেখ ‘বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গদ্যভঙ্গীর স্রষ্টা: মুজফফর আহমগদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে: ‘তবে মুজফফর আহমদে কথা বলতে হয়।’ গণবাণীর ওর গদ্যরচনায় আমি যেমন চমৎকৃত তেমনি বিমুগ্ধ হয়েছিলাম।----- এমন আশ্চর্য গদ্য তখনকার বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি।



তখন ছিল প্রমথ চৌধুরীর বীরবলী আমল। চলতি ভাষায় ফ্যাশানমৎ, বিজলী পত্রিকা শুরু হয়েছিল। সব পত্রিকার ভাষাই তখন তাই, কেবল দৈনিক সংবাদপত্রগুলি তাদের ভাষায় সাধুতা বজায় রেখেছিল তখনো।



সেকালে বঙ্কিমানুসারী ভাষায় অলংকৃত ঝঙ্কারের প্রেক্ষিতে প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় দৃঢ়বদ্ধ বিন্যাস সে যুগকে যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। সেই কালেই মুজফফর আহমদ আমদানি করলেন তাঁর আশ্চর্য গদ্য।



সোজা সব কথার সরল ঋজু গদ্য, সহজ ভাষায় ভেতর কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই, যা বলবার সোজাসুজি বলা- যা কি না তীরবেগে গিয়ে পাঠকের মর্মমূলৈ বিদ্ধ হয়। লেখার মর্ম আর পাঠকের মর্ম এক হয়ে লেখকের বক্তব্য পাঠকের অন্তরে গাঁথা হয়ে যায়। গান্ধীজীর ইয়ং ইন্ডিয়ার ইংরেজি ছিল ঠিক যে ধারার, তার সঙ্গে সমতুলনীয় ছিল মুজফফর আহমদের ঐ গদ্য।



‘উনি যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বিরাট এক সংগঠক বা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন সে সবের আমি বিশেষ কিছুই জানি না। এদেশের কমিউনিজমের কেবল অগ্রদূত নন, তার অগ্রগতির মূলেও তাঁর অবদান যে- সবিশেষ, সে বিষয়েও আমি অজ্ঞ। রাজনৈতিব বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিয়েও আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু তিনি যে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট গদ্য ভঙ্গির সষ্টা সেই কথাটাই আমার কাছে মুখ্য।



কমিউনিস্ট বলেই হয়তো এই আশ্চর্য সহজ ভঙ্গি তাঁর সহজাত হয়েছিল। কমিউনিজম যেমন মেদিনীর ক্যাপিচালিস্ট মেদভার লাঘব করতে উদ্গ্রীব-উদ্যোগী, তেমনি কমিউনিস্ট লিখিয়েদের ভাষা ভঙ্গি ওই রকম নির্মেদ নির্ভর।”



‘কাকাবাবু’ ডাকনাম প্রসঙ্গে সরোজ ম্যুখোপাধ্যায়ের ভাষায়: ‘আত্মগোপন করার নিয়ম কানুন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ রা সতর্কতা অবলম্বনের বিধি-নিষেধগুলি তিনি (কমরেড মুজফফর আহমদ) অন্যান্য কর্মীদের শিখিয়ে দিতেন। ১৯৪০ সালে গোপন আবাসে চলে যাবার পর আমিও তাঁর কাছ থেকে এসব নিয়ম-কানুন শিখেছিলাম। তখন না কায়দায় আমরা ফ্ল্যাট বা বাড়ি ভাড়া করতাম। একবার আমরা একটা বড়ো ফ্ল্যাট ভাড়া নিই। মুজফফর আহমদকে আমিই “কাকাবাবু” নাম দিই। এভাবে সমস্ত পরিবারটিকে সাজানো হয়। দুই একজন মহিলা কর্মীকেও আনা হলো স্বাভাবিক পারিবারিক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য। বাড়ির মালিককে যা বলা হলো তা হচ্ছে এইরূপ, কাকাবাবু জমিদার, অনেক টাকা পয়সা নিয়ে এপার বাংলায় এসেছেন, ভাইপোদের নিয়ে থাকেন। ভাইপোরা সন্ধ্যে বেলায় ফুর্তি করতে বের আর সারাদনি বাড়িতে ঘুমোয়। কারণ রাত্রেই আমাদের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় গিয়ে যোগাযোগ ও বৈঠক করা হতো। পাঁচু গোপাল ভাদুড়ীকে বড়দা ও সোমনাথ লাহিড়ীকে মেজদা করা হলো। আর আমি ছিলাম ছোড় দা.........।



মুজফফর আহমদকে সর্বমোট আট বছর আত্মগোপন করে কাজ করেত হয়েছিল। সেই থেকে মুজফফর আহমদ পার্টি ও বাইরের লোকের কাছ “কাকাবাবু” বলে পরিচিত। তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার-আচরণ ও ব্যবহারেও কাকাবাবুর মতই তাঁকে মনে হতো। বিশেষ করে সকলকেই তিনি স্নেহের চোখে দেখতেন। তিনি নারীদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখাতেন এবং অপরকে সেই মতো ব্যবহার করতে শেখাতেন।



আমি একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট। মীরাট মামলায় আমাকে গ্রেফতার করা হয় ২০ মার্চ, ১৯২৯। সেই দিন পর্যন্তও আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। এই গ্রেফতারের মুহুর্তের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসিয়ালি কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনাল অংশ ছিল না। আমরা সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য, শুধু এই জন্যেই আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্ভূক্ত হয় নি। কিন্তু আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যালনালের কার্যধারা, নীতি এবং কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে। সুযোগ-সুবিধা মতো সেই ভাবধারা প্রচারের দিকেও পার্টি সচেষ্ট ছিল্ ১৯২১ থেকে কমিউনিস্ট ইন্টান্যাশনালের সঙ্গে ভারতে পার্টির শাখা স্থাপনের চেষ্ট করা হয়েছে এই অভিযোগে যাদের গ্রেফতার কর হয় আমি তাদের একজন। এই “ষড়যন্ত্র” অবশ্য যদি তার কোন অস্তিত্ব থাকে, প্রমাণ করাই মামলার উদ্দেশ্য। আমার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ মন্ডলীর আমি একজন একথা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করতে পারি।



কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সবচেয়ে সাচ্চা এবং বড় বিপ্লবী সংস্থা। এই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নীতি এবং কার্যসূচী অনুসারে কাজ করেন না, এমন কোন কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্ট পার্টি আমি কল্পনাও করতে পারি না। ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির আমি একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। কিন্তু এই পার্টি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির ভেক ধারণ করেনি। তা সত্ত্বেও সরকারী অভিযোগে এ কথা বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটও সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বৈধ অস্তিত্ব আছে। ওয়ার্কর্স এ্যান্ড ডপিজেন্টস্ পার্টি এই নাম হলেও আসলে এটা কমিউনিস্ট পার্টি একথা অভিযোগে বলা অত্যন্ত হাস্যকর। আমি একজন কমিউনিস্ট। ওয়ার্কর্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টিতে যোগ দিয়ে এই দলের হয়ে কাজ করি। কারণ এই পার্টি যে জাতীয় বিপ্লবী কার্যসূচী গ্রহণ করেছিল সেটা কামিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কার্যসূচীর অন্তর্গত। আমি এবং আমার অন্যান্য কমিউনিস্ট কমরেডরা এই ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির সদস্য। এর হয়ে কাজ করেছি বলেই যে এই পার্টি একটি ছদ্ম কমিউনিস্ট সংস্থা একথা মনে করা নিতান্তই বাতুলতা। আমি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় একজিকিউটিভ অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। আমার অনেক কমিউনিস্ট কমরেডরাও ছিলেন। এই ভিত্তিতে সরকার পক্ষের অভিযোগে কি একথা বলা হবে যে জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় একজিকিউটিভ অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিও একটি ছদ্ম কমিউনিস্ট সংস্থা।



শ্রমিক, কৃষক আর বিভিন্ন সংস্থার পেটিবুর্জোয়া এইসব শোষিত শ্রেণীর রাজনৈতকি পার্টি ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি। তাদের ইচ্ছ ভারতের জাতীয় মুক্তি সাধন। তারা এমন এক গণতান্তিক প্রজাতন্ত্র স্থাপন করতে চায় যাতে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিক কৃষক এবং অন্যান্য শোষিত শ্রেনীর থাকবে সমান অধিকার। শ্রেণীদ্বন্দ্ব তীব্রতর করাই এইদলের লক্ষ্য। শোষিত শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতবি এবং সংগ্রামী সচেতনতা বাড়িয়ে তোলাই তার কাজ। এই ওয়ার্কাস এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি চায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত এক সার্বিক জাতীয় স্বাধীনতা। মাধ্যম-গণ-আন্দোলন এবং বুর্জেয়া ডেমোক্র্যাটিক রেভলিউশন। দলের কার্যসূচীতে তারা সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেনি। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাও তাদের কাম্য নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্দে এর ভূমিকা ছিল বিপ্লবী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভূমিকা। সামগ্রিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করার উদ্দেশ্য কয়েকটি শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করা হয়। তাদের লক্ষ্যের সমতা বিচার করে একটু ব্যাপক ভিত্তিতে এই দল গঠন করা হয়।



আসলে রাজনৈতিক দলের ব্যাপকতর সংজ্ঞায় ওয়ার্কাস এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টিকে রাজনৈতিকপার্টি বলা যেতে পারে। শ্রেণী সংগ্রামের সকল ক্ষেত্রে যে সংস্থা একটি শ্রেণীর বা শ্রেণী অংশের স্বার্থে অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রকাশ করে প্রকৃত অর্থে তার নাম রাজনৈতিক পার্টি। এই প্রহঙ্গে একথা বলা দরকার যে, শ্রেণীর জন্য পার্টি, তার সবচেয়ে শ্রেণীসচেতন সক্রিয় অংশ নিয়েই সেই পার্টি, গঠন করা হয়। শ্রেণী এবং জাতি গুলিয়ে ফেলা কিন্তু সমীচীন নয়। জনগণের যে অংশের অর্থনৈতিক বৃত্তি (ইকনমিক ফাংশন) সমান এবং ফলত রাজনৈতিক স্বার্থ এক- এদরে নিয়েই শ্রেণী গঠিত হয়। জাতীয় স্বাধীনতার জন্য একটি পরাধীন জাতির সংগ্রাম এবং রাজনৈতকি শোষণ থেমে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী মুক্ত হওয়ার সংগাম- এই দুটো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরিষ্কার করে বলতে গেলে একই সংগে আমাদের দু’টো সংগ্রাম। গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক অধীনতা থেকে ভারতের মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শ্রমিক ও কৃষকের মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম। একটিকে অন্যটি থেকে পৃথক করা যায় না। নিজ নিজ ক্ষেত্রে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে শ্রেণী শত্রুকে ক্রমশঃ দুর্বল করে দিতে হবে। সম্মিলিতভাবে বি্রুটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তারা প্রচন্ড আঘাত করবে- আঘাত করবে তার ভারতীয় মিত্রদের- জমিদার, দেশীয় রাজ্যের রাজন্যবর্গ, উচ্চ সুদ গ্রহণকারূ উত্তমবর্ণকে। ভারতের মতো পরাধীন ঔপনিবেশিক দেশে সামন্ততন্ত্রের অবশেষ এখনও বর্তমান। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা আশঙ্কাজনকভাবে পশ্চাৎপদ, প্রায় আদিযুগের। দেশীয় রাজ্যগুলিতে এখনও সামন্ততান্ত্রিক ভূমিদাস-ক্রীতদাস প্রথা এবং জনগণকে প্রায় বর্বর অবস্থায় রেখে দেবার অধিকার দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের আশু উদ্দেশ্য সর্বহারা বিপ্লব নয়- সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করাও নয়। বন্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস পাঠে কমিউনিস্টরা বুঝতে পেরেছে সর্বহারা বিপ্লবের আগে বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাটিক রেভলিশনের স্তর, এবং সেই স্তার আগে অতিক্রম করা দরকার।



কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ওয়াল্ড কংগ্রেসের কলোনিয়াল থিসিসে এই স্তর কিভাবে অতিক্রম কর যায় তারই নির্দেশ দেওয়া হায়েছে। ওয়ার্কাস এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির কর্মসূচী এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক রেভলিউশনের কার্যসূচী প্রণয়নের ভিত্তি বাস্তব, অবজেকটিভ পরিস্তিতি ও বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গী, কার্যসূচীর এই আংশিক মিলনের জন্যই আমি ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টিতে যোগদান করি- এর হয়ে কাজ করি। একথা আগেও বলেছি। বুর্জোয়া সংস্কারপন্থী সংস্থা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যোগদান করি। কংগ্রেস কর্র্মীদের যে পেটিবুর্জোয়া অংশের বিপ্লবের প্রতি প্রবণতা ছিল, তাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতানা বাড়ানোই ছিল আমার কাজ।



বাংলাদেশের ওয়ার্কাস এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পার্টির একজিকিউটিভ কমিটির রিপোর্ট-এ কল টু ফ্রারাকশন নামক পুস্তিকা এবং লেবার পার্টির নীতি ও কর্মসূচী আলোচনা পর্যালোচনা করে এই তথ্য জানা যায়। অবশ্য তখন নাম ছিল লেবার স্বরাজ পার্টি অব দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতারা পার্টি গঠন করেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী বিপ্লবী অংশ হিসেবে কাজ করার জন্য। কিন্তু শীঘ্রই তাদের ভুল ধরা পড়ে। জাতীয় বিপ্লবী পার্টির লক্ষ্য-পূর্ণ স্বাধীনতা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা। বোঝা গেল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস থেকে এ ধরনের পার্টি সম্ভব নয়। ঐ দল ভারতীয় বুর্জোয়াদের সংস্কারপন্থী সংস্থা। তাদের মিত্র ভূ-মালিক গোষ্ঠী ও কর্মীরা সকলেই পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর। শ্রমিক ও বুর্জোয়া এবং কৃষক ও জমিদার উভয়ের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী। সেইজন্য এই দলে কোন শ্রেণী সচেতন অংশ ছিল না, থাকা সম্ভবও ছিল না। যদি কখনও দেখা যায় কৃষক ও শ্রমিকের এক অংশ কংগ্রেসের অনুসারী তা হলে বুঝতে হবে সেই অনুসরণ সচেতনভাবে নয়। বলতে হবে মিথ্যা স্লোগান তাদের সম্মোহিত করেছে। কংগ্রেসী বুর্জোয়া ভূস্বামীদের সঙ্গে কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থের সংঘাত বর্তমান। উভয়ে লক্ষ্যে কোন সাধারণ সমতাও নেই। অতএব ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রেক্ষপটে লেবার স্বরাজ পার্টি তার বিপ্লবী অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারল না।



১৯২৬ সালের প্রথম দিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে এই দল সম্পর্ক ছেদ করে। কৃষ্ণনগরে কৃষ, শ্রমিক, পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধির এক সম্মেলনে এই পার্টি পুনর্গঠিত হয় নাম পরিবর্তন করা হয় ‘বেঙ্গল ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি। অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষক দল। বাংলাদেশের ময়মন সিংহ জেলার ১৯২৪ পর্যন্ত এই নামে একটি সংস্থা ছিল। ঐ নাম অনুসারেই এই নাম। কাজেই বলা যেতে পারে ১৯২৪ সাল থেকেই ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির উদ্ভব। অবশ্য তখন শুধু কৃষকদের সঙ্গেই ঐ পার্টির যোগ ছিল। পরে ১৯২৮ সালের এপ্রিলে বেঙ্গল পিজেন্টস্ এ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির ভাটাপাড়া সম্মেলনে ইংরেজী নামের একটু পরিবতর্ণ করে নাম হয় ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি অব বেঙ্গল। ততদিনে ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি অব বম্বে তৈরী হয়ে গেছে। সেই নামেই সঙ্গে অর্থগত মিল রাখার জন্যই এই নাম বদল। ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির বিভিন্ন কর্মীদের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৯২৮ এর ডিসেম্বরে। এখানে সমস্ত পার্টি মিলে একটি পার্টি তৈরী হয়। ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি অব ইন্ডিয়া, ‘অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স’ এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি” নয়। আমার অন্যান্য সহকর্মীরা ভুল করে এই নামই উল্লেখ করেন। অতি সংক্ষেপে ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি সৃষ্টির এই হল ইতিহাস।



কুতুবুদ্দিন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার এবং মৃত সামসুদ্দিন হোসেন- এই চারজন লেবার স্বরাজ পার্টি গঠনের ব্যাপারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা কিন্তু কখনই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।



ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টির লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাটিক রেভলিউশন। সেই সম্পের্কে এখন আমি কিছু বলতে চাই। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় ও ষ্ঠ ওয়াল্ড কংগ্রেসের অনুষ্ঠানকাল যথাক্রমে ১৯২০ ও ১৯২৮। এই সময়কার থিসিসে “রেভুলিউশনারি মুভমেন্টস্ ইন দি কালোনিস” সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে ভাতের পূর্ণ-স্বাধীনতার জন্য বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাটিক রেভুলিউশন অপরিহার্য। মি. গান্ধী তথা ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যে ধোঁকাবাজীপূর্ণ স্বরাজের কথা বলেন, এই স্বাধীনতার অর্থ কিন্তু সে রকম নয়। আর কথাটি এমন যে- ইচ্ছা মনত যে কেই তার অর্থ যেমন খুশী ভেঙ্গে চরে দাঁড় করতে পারে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ভন্ডামীর সঙ্গে পুর্ণ-স্বাধীনতার অর্থে পূর্ণ-স্বরাজ কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। উদ্দেশ্য, কর্মীদের সন্তুষ্ট করা আর সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভয় দেখানো। তাঁদের কাছে এটি একটি বুলি মাত্র- তার বেশি কিছু নয়। আপোষ আলোচনায় পথ খুলে গেলে এর প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে। তখন এর অর্থ দাঁড়াবে সাম্রাজ্য, ডেমিনিয়ন স্ট্যাটাস এবং সাবসেটস অব ইন্ডিপেন্ডেন্স- এর মধ্যে সমান অংশীদারী। সাদা কথায় মি. গান্ধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের “আলিঙ্গনবদ্ধ হতে প্রস্তুত” হচ্ছেন।



বুর্জোয়া ডেমোক্যাটিক রেভুলিউশনের মাধমে আমরা অর্জন কররো পূর্ণ জাতীয় আত্মা-প্রত্যয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে এক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অংশ শ্রমিক ও কৃষকদের সোভিয়েত রিপাবলিক।



বুর্জোয়া এবং সাম্রাজ্যবাদ- এ্ই কথা দু’টার আগে ব্যাখ্যা করা উচিত। নয়া পুঁজিবাদীদের যে অশের অধিকার উৎপাদনের হাতিয়ার অর্থাৎ যন্ত্রপাতির আছে এবং বেতনভোগী শ্রমিক নিয়োগের অধিকার যাদের তাহে- তাদেরই বুর্জোয়া বলে। ফলে যাদের কোন সম্পত্তি বা উৎপাদনের হাতিয়ার সেই সহ শ্রমিক শ্রেণী নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যাচারী বুর্জোয়াদের শোষণের কাছে বাধ্য হয়ে বশ্যতা স্বীকার করে। সুলভ শর্তে কাজ করতে বাধ্য হয়। সাম্রাজ্যবাদ ধনতন্ত্রের একটি পরিণত এবং বিকশিত রূপ। স্বদেশের শ্রমিক শোষণের মধ্য দিয়েই ধনিক গোষ্ঠির হাতে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এর প্রসারের জন্য দরকার হয়ে পড়ল ব্যাপক বাজার এবং কাঁচামালের নতুন উৎস সন্ধান। প্রথমে উপনিবেশ জয়ের সময় অভিযান, পরে ধনতন্ত্র , ব্যাপক শিল্প উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশে বৃহদায়তন একচেটিয়া শিল্পসংস্থা গঠন করে------- নিজেদের শিল্পে অন্য দেশ প্রতিষ্ঠিত করে, শিল্প ক্ষেত্রে তার শোষণ কায়েম করে----- নতুন দেশে রপ্তানী করা হলো রেলওয়ে সরঞ্জাম, মেশিন এবং পুঁজি। সহায়হীন শ্রমিকদের সুলভতায় সেখানে গড়ে ওঠে শিল্প সংস্থা। তাকে সম্বল করেই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্য রাজনৈতিক ক্ষমতা বাঁচিয়ে রাখে। সেই দেশের শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে সুদ আর মুনাফার ভাগ বাটোয়ারা হয় সাম্রাজ্যবাদের এই হলো নয়া চেহারা অর্থাৎ লগ্নি-পুঁজি সাম্রাজ্যবাদ। যার বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াকু এক সৈনিক কমরেড মুজফফর আহমদ।

http://biplobiderkotha.com/?option=com_content&view=article&id=206:2010-07-20-08-41-55&catid=36:bengali-revolutionary-&Itemid=27&fontstyle=f-larger

No comments: