20160805
কাকাবাবুর জন্মদিনে শপথ
বিমান বসু
কমরেড
মুজফ্ফর আহ্মদ আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভারতের বুকে কমিউনিস্ট
আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৮৮ সালে অধূনা বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলার
সন্দ্বীপে তাঁর জন্ম হয়।
আজকের
প্রজন্মের জানা প্রয়োজন, সাধারণভাবে আমাদের
পার্টির কোনো নেতার জন্মদিন বা মৃত্যুদিন প্রকাশ্যে পালন করার রীতি চালু নেই।
কিন্তু কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রমী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬৩
সালে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এবং পার্টি সংগঠনের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে বিতর্ক দেখা
দিলে প্রকাশ্য পার্টি, জেল পার্টি ও
আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির যৌথ সিদ্ধান্তে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রথমবার
তাঁর জন্মদিন পালিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে মুজফ্ফর সাহেব এই জন্মদিন পালনের ঘোরতর
বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মদিন পালনের মধ্যে
দিয়ে ব্যক্তিপূজার বিষয়টি এসে যায়।’ তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ‘আপনার বিষয়টি একটু আলাদা, কারণ আপনি আমাদের পার্টির শীলমোহর হয়ে গেছেন।’ উত্তরে মুজফ্ফর সাহেব বলেছিলেন, ‘তা আবার হয় নাকি!’
একথা
আমাদের সকলেরই জানা যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম গড়ে ওঠে প্রবাসে (তাসখন্দে)
১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর। এই পার্টির পক্ষ থেকে ১৯২১ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের
৩৬তম আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশিত ইস্তেহার প্রচারের অন্যতম
দায়িত্বে ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ। অধিবেশন কক্ষে প্রচারপত্র বিলি করার পরই
মুজফ্ফর সাহেব দেশের যেখানেই যাতায়ত করতেন, সেখানেই তাঁর ওপর ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি শুরু হয়ে যায়। মুজফ্ফর সাহেবের
কমিউনিস্ট কার্যকলাপের ফলস্বরূপই তাঁর বিরুদ্ধে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা ও মীরাট
ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। উভয় মামলার মুজফ্ফর সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থনে যেসব
বক্তব্য উত্থাপন করেছিলেন, তা সেই সময়ের
সংবাদপত্রে কিছু কিছু প্রকাশিত হওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টি
আকৃষ্ট হয়েছিল। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়
মনোভাব ও অকুতোভয় সওয়াল করার ঘটনা তৎকালীন সময়ে দেশের বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল
এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট করতে সাহায্য করেছিল।
বিংশ
শতাব্দীর বিশের দশকে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা
খুবই কঠিন ছিল। এমনিতেই যেখানে মুজফ্ফর সাহেব যেতেন, সেখানেই ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি শুরু হয়ে যেতো।
স্বাভাবিকভাবে পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অভিযান করার জন্য তাঁকে বেশিরভাগ সময়
আত্মগোপনে যেতে হতো এবং গোপন ডেরা থেকে কৌশল অবলম্বন করে নানা যোগাযোগ স্থাপন করতে
হতো। এমনই একটি আত্মগোপনের ডেরায় বেশিদিন থেকে কমিউনিস্ট কার্যকলাপ পরিচালনা করতে
হয়েছিল। সেই পরিবারের সদস্যরা মুজফ্ফর সাহেবকে ‘কাকাবাবু’ বল সম্বোধন করেন। সেই সময় থেকেই
তিনি পার্টির অভ্যন্তরে এবং বেশ কিছু বাইরের জগতের মানুষের কাছেও ‘কাকাবাবু’ হয়ে ওঠেন।
ভারতের
কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার প্রথম যুগে কাকাবাবু ও সহকর্মীদের এক অত্যন্ত প্রতিকূল
পরিবেশে খুব কষ্টকর জীবনযাত্রা নির্বাহ করে মার্কসবাদী মতাদর্শের পক্ষে প্রচার
করতে হতো। কী ধরণের আত্মত্যাগে ব্রতী হয়ে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে কমিউনিস্ট
কার্যকলাপ পরিচালনা করতে হতো, তা এই সময়ে আমাদের
অনেকের উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। এই কঠিন জীবনযাপন করেও কাকাবাবু এরাজ্যে
শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মেহনতকারী জনগণের স্বার্থে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে
যুক্ত রেখে বিভিন্ন প্রদেশে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলার কাজেও নিজে
ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কাকাবাবু
নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসে অবিচল থেকেও সব ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন।
কাকাবাবুর রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস না করা বিশিষ্টজনেরাও তাঁর আচার-আচরণ ও
ব্যবহারে মুগ্ধ হতেন। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন কমিউনিস্ট হিসেবে অনেকেই তাঁকে
শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। উল্লেখ্য, কাকাবাবু বিশ্বাস
করতেন,
প্রকৃত কমিউনিস্ট হয়ে গড়ে উঠতে হলে অবশ্যই তাঁকে প্রকৃত
মানুষ হতে হবে। তিনি সারাজীবন সরল, সাধারণ জীবনযাত্রার আদর্শকে মান্য করে পার্টির আভ্যন্তরীণ কাজ ও গণ-আন্দোলন
প্রসারিত করার লক্ষ্যে পথ চলেছেন। এককথায় বলা যায় যে কাকাবাবু প্রকৃত অর্থে একজন
আত্মত্যাগী কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। তাঁর জীবনাদর্শকে বর্তমান প্রজন্মের
কমিউনিস্টদের পাথেয় করে চলার মধ্যে দিয়েই এই সময়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও কার্যকলাপের
প্রতি শ্রমজীবী মানুষকে আকৃষ্ট করার কাজে যুক্ত থাকা একান্ত জরুরী।
আমরা সকলেই
জানি,
আমাদের দেশে গত ২৬মাস ধরে সাম্প্রদায়িক দল বি জে পি-র
নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার চলছে। আবার, এই সরকার এক চরম দক্ষিণপন্থী সরকার। ফলে, প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহৎ পুঁজিপতি ও দেশী-বিদেশী
কর্পোরেটের স্বার্থে সরকারী অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনা করে চলেছে। এই সর্বনাশা নীতির
বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে শুরু করেছে।
আবার এই সরকারের মূল চালিকাশক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আর এস এস, যারা দেশের জনগণের ঐক্য-সংহতি ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ধ্বংস
করার কাজে যুক্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ছোট ও মাঝারি
সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটেছে। অন্যদিকে, এই সাম্প্রদায়িক শক্তি জাত ও বর্ণের বিরোধ তৈরি করে দেশে বেশ কয়েকটি জাতের
সংঘাত তৈরি করেছে।
এই
সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার
রাজ্যবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র ধ্বংস করে একদলীয় শাসন কায়েম করার কর্মসূচী ২০১১ সালে নির্বাচনে জয়লাভের
পর থেকেই শুরু করেছিল, যা ২০১৬ সালে
দ্বিতীয়বার রাজ্য সরকার গড়ে তুলে বিরোধীদের কন্ঠ রুদ্ধ করার জন্য রাজ্যের সব
পঞ্চায়েত ও পুরসভা দখল করার বীভৎস খেলায় যুক্ত রয়েছে। আবার এই তৃণমূল সরকার
প্রকাশ্যে বি জে পি-র বিরোধিতার কথা বলে কিন্তু আসলে বি জে পি-র সঙ্গে
যুক্তি-পরামর্শের ভিত্তিতেই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার খর্ব করছে। ইতিমধ্যে একটি
মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার কর্মসূচী
নিয়ে চলছে। দেশের সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, সর্বভারতীয় কর্মচারী ফেডারেশন ও ইউনিয়নের ডাকা ২রা
সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের বিরোধী অবস্থান নিতে চলেছে তৃণমূল সরকার।
রাজ্যের সমস্ত বামপন্থী দল ইতিমধ্যেই ২রা সেপ্টেম্বরের হরতালের কর্মসূচীকে সমর্থন
করে প্রচার শুরু করেছে।
আমাদের
রাজ্যে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী কার্যকলাপের সামনে এক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি
গড়ে উঠেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেই গণ-আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশ গড়ে
তোলার কাজে আমাদের সকলকে নিষ্ঠা ও সাহসে ভর করে যুক্ত হতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে
হবে,
কাকাবাবু প্রথমে যুক্ত বঙ্গে ও পরে এরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে
নানা পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট কার্যকলাপ ও গণ-আন্দোলন পরিচালনা করেছেন।
এই
পথপ্রদর্শকের জন্মদিনে আমাদের সকলের শপথ হোক, গণ-আন্দোলনের বিকাশ ঘটিয়ে জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত থাকবো।
গণশক্তি, ৫ই আগস্ট, ২০১৬
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment